ট্রাম্পের "নৈশভোজ কূটনীতি": ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষবিরতির কৃতিত্ব নিয়ে রাজনৈতিক সমীকরণ জটিল
আমেরিকান বাণিজ্য-চাপের দাবি বনাম ভারতীয় সামরিক কর্তৃত্ব
ওয়াশিংটন/নয়াদিল্লি, ১৪ মে ২০২৫: আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষবিরতিতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা দাবি করে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। তিনি বাণিজ্যিক চাপকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এই সংঘর্ষ থামানোর কৃতিত্ব নিজের দাবি করেছেন এবং আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মূল্যায়ন করেছেন যে "ভারত-পাকিস্তান একসঙ্গে ভালই এগোচ্ছে।"
ট্রাম্পের উস্কানিমূলক প্রস্তাব
মঙ্গলবার রাতে ট্রাম্প বিস্ময়কর ভাবে বলেন, "ভারত এবং পাকিস্তানের দুই রাষ্ট্রনায়কই খুব ক্ষমতাশালী, শক্ত এবং সপ্রতিভ। সব থেমে গিয়েছে, আশা করি থেমেই থাকবে। ওরা একসঙ্গে ভালই এগোচ্ছে। আমরা হয়তো ওঁদের একসঙ্গে নৈশভোজেও বসাতে পারি।"
আরও উদ্বেগজনক দাবি করে তিনি যোগ করেন, "সংঘর্ষটা ছোট আকারে শুরু হলেও বড় দিকে এগোচ্ছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যেতে পারতেন।" এই বক্তব্যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে ট্রাম্প পরমাণু যুদ্ধ থেকে উভয় দেশকে রক্ষা করেছেন।
ভারতের পাল্টা জবাব
ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই দাবিগুলি স্পষ্টভাবে খণ্ডন করেছেন। তিনি সময়সূচী তুলে ধরে বলেন, "দু'দেশের ডিজিএমও-দের মধ্যে সংঘর্ষবিরতির নির্দিষ্ট তারিখ, সময় এবং শব্দ নিয়ে কথা হয়েছে ১০ মে বিকেল ৩টে ৩৫ মিনিটে। এই ফোন কলের অনুরোধ বিদেশ মন্ত্রকের কাছে আসে পাকিস্তানের দূতাবাস থেকে দুপুর ১২টা ৩৭ মিনিটে।"
জয়সওয়াল আরও স্পষ্ট করেন, "১০ তারিখ সকালেই পাকিস্তানের প্রধান বিমানঘাঁটিগুলি আমরা আক্রমণ করি। এর পরই তারা গুলি চালানো এবং সামরিক অভিযান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই বিষয়টি স্পষ্ট করে নেওয়া ভাল যে, ভারতীয় সেনাই পাকিস্তানকে বাধ্য করেছে গুলি চালানো বন্ধ করতে।"
কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের অটল অবস্থান
কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতা প্রসঙ্গে ট্রাম্পের প্রস্তাব নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে জয়সওয়াল দৃঢ়ভাবে বলেন, "আমাদের দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় অবস্থান হল, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে শুধুমাত্র ভারত এবং পাকিস্তানই দ্বিপাক্ষিক ভাবে কথা বলবে। এই ঘোষিত অবস্থানের কোনও পরিবর্তনই হয়নি। আপনারা জানেন পাকিস্তান বেআইনি ভাবে ভারতীয় ভূখণ্ড জবরদখল করে রেখেছে।"
পরমাণু হুমকির বিষয়ে স্পষ্টতা
পরমাণু সংঘাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে উঠে আসা জল্পনা নিয়েও জয়সওয়াল ব্যাখ্যা দেন, "একটি রিপোর্ট এসেছিল যে, পাকিস্তান ১০ মে তাদের পরমাণু সংক্রান্ত জাতীয় কমান্ড অথরিটি-র বৈঠক ডেকেছে। কিন্তু সেটাও তারা অস্বীকার করে। তাদের দেশের বিদেশমন্ত্রীই পরমাণু সংক্রান্ত কোনও পদক্ষেপের কথা অস্বীকার করেছেন।"
বিরোধী দলের সমালোচনা
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, "জয়শঙ্কর এমনিতে অনেক কথা বলেন। ট্রাম্পের ভূমিকা এবং ভারত-পাক আলোচনা প্রস্তাব নিয়ে তিনি কিন্তু নীরব।"
ট্রাম্পের নতুন বক্তব্যের পরে কংগ্রেস নেতা পবন খেরা ক্ষোভ প্রকাশ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, "ট্রাম্প আবার বাণিজ্যের কথা বললেন! ভারত-পাক আবার হাইফেনবদ্ধই হল না শুধু, তিনি মোদী আর শাহবাজ শরিফের মধ্যে তুলনাও করলেন! প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এটা মেনে নেবে?"
সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে আশ্চর্যজনক নীরবতা
উল্লেখযোগ্য যে কয়েক মাস আগে আমেরিকা সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং ট্রাম্প সন্ত্রাসবাদ দমন নিয়ে একমত হয়েছিলেন। অথচ ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বিবৃতিতে পহেলগামে পাকিস্তানি জঙ্গি-তাণ্ডবের কোনও উল্লেখ দেখা যায়নি। বরং তিনি সংঘর্ষবিরতির জন্য পাকিস্তানের প্রশংসা করে তাদের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর কথাই বলছেন।
অগ্রাহ্য করা যায় না যে বাণিজ্যিক স্বার্থ
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের নতুন বক্তব্য দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রতিফলন। প্রশাসনের প্রথম মেয়াদে ঘোষিত "আমেরিকা ফার্স্ট" নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এই অবস্থান ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
একদিকে ট্রাম্প যেখানে ভারত-পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে "নৈশভোজ কূটনীতি"র স্বপ্ন দেখছেন, সেখানে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জটিলতা, কাশ্মীর ইস্যু, সন্ত্রাসবাদ এবং সীমান্ত সংঘর্ষ এখনও অমীমাংসিত।
তবে এই পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়াতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে, যেখানে ভারতকে সতর্কতার সঙ্গে কূটনৈতিক পাশা খেলতে হবে।
বিশেষ সংবাদদাতা দ্বারা প্রতিবেদিত