আহমেদাবাদের ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় গোটা দেশ শোকস্তব্ধ - এক দশকের সবচেয়ে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা
১২ জুন ২০২৫, বৃহস্পতিবার বিকেল ১:৩৮ মিনিটে আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট এআই১৭১। বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার বিমানটিতে ছিল ২৪২ জন যাত্রী ও ক্রু সদস্য। কিন্তু টেকঅফের মাত্র পাঁচ মিনিট পরেই ঘটে যায় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
বিমানটি উড্ডয়নের পর প্রাথমিক উচ্চতা অর্জন করলেও হঠাৎ করে নিচের দিকে নামতে শুরু করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, বিমানটি গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর একটি বিকট শব্দের সাথে আগুনের গোলা তৈরি হয়। বিমানটি আছড়ে পড়ে আহমেদাবাদের মেঘানিনগর এলাকার একটি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে, যেখানে দুপুরের খাবারের সময় অনেক ছাত্র ও চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন।
একমাত্র জীবিত ও তার বর্ণনা
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় একমাত্র জীবিত ব্যক্তি হলেন ৪০ বছর বয়সী ব্রিটিশ নাগরিক বিশ্বাশ কুমার রমেশ। তিনি ১১এ সিটে বসে ছিলেন এবং ইমার্জেন্সি এক্সিট রো-তে থাকার কারণে দুর্ঘটনার পর লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, "টেকঅফের ত্রিশ সেকেন্ড পরে একটা জোরে আওয়াজ হল এবং তারপরেই বিমান ক্র্যাশ করল। সবকিছু খুব দ্রুত ঘটেছে।"
রমেশ আরও বলেন, "আমি উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে পালিয়েছি। আমার চারপাশে বিমানের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কেউ একজন আমাকে ধরে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।" তার মুখে আঘাতের চিহ্ন ও রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু তিনি কীভাবে রক্ষা পেলেন তা বুঝতে পারছেন না।
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
এই দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২৪০ জনের বেশি বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা। গুজরাতের উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা বিধি চৌধুরী রয়টার্সকে জানান, "আমরা এখনও মৃতের সংখ্যা যাচাই করছি, যার মধ্যে রয়েছে যে ভবনে বিমানটি আছড়ে পড়েছে সেখানকার নিহতরাও।" পূর্বে ২৯৪ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও পরে তা সংশোধন করা হয় কারণ কিছু দেহের অংশ দুইবার গণনা করা হয়েছিল।
বিমানটি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে আছড়ে পড়ায় সেখানকার কিছু ছাত্র ও স্টাফও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। একজন মায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, তার ছেলে দুপুরের খাবারের জন্য হোস্টেলে গিয়েছিল এবং বিমান আছড়ে পড়ার সময় দ্বিতীয় তলা থেকে লাফ দিয়ে নেমে আহত হয়েছে।
নিহতদের পরিচয়
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন পাথানামথিট্টার পুল্লাদের ৪০ বছর বয়সী নার্স রেঞ্জিতা আর নায়ার (রেঞ্জিতা গোপকুমার নামেও পরিচিত)। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে পাঁচ বছর কাজ করার পর সম্প্রতি লন্ডনে চাকরি পেয়েছিলেন। তার মৃত্যুর খবরে তার বয়স্ক মা এবং ১০ ও ৭ বছর বয়সী দুই সন্তান গভীর শোকে মুহ্যমান।
আহমেদাবাদের স্থানীয় একজন মহিলা পূনম প্যাটেল জানান, তার শ্যালিকা এই লন্ডনগামী ফ্লাইটে ছিলেন। "এক ঘণ্টার মধ্যে আমি খবর পেলাম যে বিমানটি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়েছে," তিনি দুঃখের সাথে বলেন।
সরকারি প্রতিক্রিয়া ও উদ্ধার কার্যক্রম
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক্স (টুইটার) এ পোস্ট করে বলেন, "আহমেদাবাদের এই ট্র্যাজেডি আমাদের স্তম্ভিত ও দুঃখিত করেছে। এটি কথায় প্রকাশ করার মতো হৃদয়বিদারক।" গুজরাত তার নিজের রাজ্য হওয়ায় তিনি ব্যক্তিগতভাবেও শোকাহত।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে কথা বলে সমস্ত কেন্দ্রীয় সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এনডিআরএফ টিম ও কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ণ সহায়তা উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য প্রদান করা হচ্ছে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার জানান যে দুর্ঘটনার ছবিগুলো "ধ্বংসাত্মক"। ব্রিটেনও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করে এই দুর্ঘটনার তথ্য উদঘাটন এবং সংশ্লিষ্টদের সহায়তা প্রদানে সহযোগিতা করছে।
বিমান সংস্থার বিবৃতি
এয়ার ইন্ডিয়া একটি বিবৃতিতে জানায়, "ফ্লাইট এআই১৭১, আহমেদাবাদ-লন্ডন গ্যাটউইক রুটে পরিচালিত, ১২ জুন ২০২৫ তারিখে একটি ঘটনায় জড়িত হয়েছে। এই মুহূর্তে আমরা বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছি এবং দ্রুততম সময়ে airindia.com এবং আমাদের এক্স হ্যান্ডেলে আরও আপডেট শেয়ার করব।"
বিমানবন্দরের অবস্থা
আহমেদাবাদ বিমানবন্দর দুর্ঘটনার পর সকল ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে সীমিত ফ্লাইট নিয়ে আবার পরিচালনা শুরু করা হয়। বিমানবন্দরটি ভারতের আদানি গ্রুপ কর্তৃক পরিচালিত।
কেরালা থেকে আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিষেবা এই দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।
তদন্ত ও প্রযুক্তিগত দিক
বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার একটি ওয়াইড-বডি, টুইন-ইঞ্জিন বিমান যা ২০১১ সালে চালু হয়েছিল। ফ্লাইটরাডার২৪ এর তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ১,০০০+ এই মডেলের বিমান বিভিন্ন এয়ারলাইনসে ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। এই মডেলটি জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং কম শব্দ উৎপাদনকারী হিসেবে প্রশংসিত। তবে বৃহস্পতিবারের এই দুর্ঘটনাই প্রথম বোয়িং ৭৮৭ এর সাথে জড়িত।
বিমান নিরাপত্তা পরামর্শদাতা জন কক্স এসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, তদন্তকারীরা প্রশ্ন তুলবেন বিমানটি ফ্লাইটের জন্য সঠিকভাবে কনফিগার করা ছিল কিনা। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এখনই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো খুব তাড়াতাড়ি, তবে গ্রেইনি ছবিগুলো দেখে মনে হচ্ছে একটি তদন্তের ক্ষেত্র হতে পারে যে বিমানটি উড্ডয়নের চেষ্টা করার সময় স্ল্যাট এবং ফ্ল্যাপগুলো সঠিক অবস্থানে ছিল কিনা।
বোয়িং কোম্পানির শেয়ার এই দুর্ঘটনার পর ৫% পতন হয়েছে। মার্কিন পরিবহন সচিব জানিয়েছেন যে ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বোয়িং এবং জিই এর সাথে তদন্তে কাজ করছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
এই দুর্ঘটনা ১৯৮৮ সালের ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস ফ্লাইট ১১৩ এর দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়, যেটিও আহমেদাবাদে ঘটেছিল। ভারতে সর্বশেষ মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২০২০ সালে এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের একটি বোয়িং-৭৩৭ দক্ষিণ ভারতে একটি "টেবিল-টপ" রানওয়ে ওভারশুট করে উপত্যকায় পড়ে যায়, যাতে ২১ জন নিহত হয়েছিল।
এয়ার ইন্ডিয়া পূর্বে সরকারি মালিকানাধীন ছিল এবং ২০২২ সালে ভারতীয় টাটা গ্রুপ এটি অধিগ্রহণ করে। ২০২৪ সালে এটি ভিস্তারার সাথে একীভূত হয়, যা টাটা গ্রুপ ও সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের যৌথ উদ্যোগ ছিল।
আন্তর্জাতিক প্রভাব
এই দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপী বিমান চলাচলের নিরাপত্তা নিয়ে আবারও প্রশ্ন তুলেছে। বোয়িং কোম্পানি যেটি ইতিমধ্যে নিরাপত্তা ও উৎপাদন চ্যালেঞ্জের জন্য সমালোচনার মুখে রয়েছে, তাদের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা। নতুন সিইও এর অধীনে কোম্পানিটি বিশ্বাস পুনর্গঠনের চেষ্টা করছিল।
জিই এয়ারোস্পেস জানিয়েছে যে তারা ভারতে একটি দল পাঠিয়ে ককপিট ডেটা বিশ্লেষণের জন্য কাজ করবে।
শোকের ছায়া
এই দুর্ঘটনা কেবল ভারতেই নয়, বিশ্বব্যাপী শোকের ছায়া ফেলেছে। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ভারতীয়রা এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। অনেক পরিবার তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছে, যারা নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন।
এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে যে বিমান পরিবহনে নিরাপত্তার কোনো বিকল্প নেই এবং প্রতিটি উড্ডয়নের পূর্বে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
লেখকের নোট: এই আর্টিকেলটি সর্বশেষ উপলব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে। ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত চলমান রয়েছে এবং নতুন তথ্য প্রাপ্তির সাথে সাথে আপডেট করা হবে। নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।